সোহেল রানা, মহাদেবপুর (নওগাঁ) প্রতিনিধি : ২৭ জুলাই মঙ্গলবার। ঘড়ির কাটা তখন বিকেল ৪টা ছুঁইছুঁই। মহাদেবপুর সদরের বুলবুল সিনেমা হল এলাকায় এক মোটরসাইকেলচালক মুঠোফোনে একজনকে বলছে, ‘বাবা ডাল আছে?’ এর মাত্র ১০ মিনিট পরই চার্জারভ্যান নিয়ে হাজির খোকন, যাকে ফেনসি খোকন নামে সবাই চেনে। সঙ্গে নিয়ে আসে ‘ডাল’, মানে ফেনসিডিল। বিশ্বাস মার্কেটের পিছনে গিয়ে ব্যাগ থেকে দু’বোতল ‘ফেনসিডিল’ বের করে দেন ওই যুবকের হাতে। গুনে নেন নগদ টাকা। টাকা পেয়ে খোকন ভ্যান নিয়ে হাওয়া। এটি শুধু নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা সদরের সিনেমা হল ও বিশ্বাস মার্কেটের পিছনে নয়, কলেজ পাড়া, লিচু বাগান, ডাকবাংলো মাঠ, চকগোবিন্দ, ঘোষপাড়া, ফায়ার সার্ভিস, বছনা ব্রিজ, শিবগঞ্জ মোড়, কুঞ্জবনসহ সর্বত্র একই চিত্র। কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে, আবার কখনো তাদের সামনেই চলছে মাদক বিক্রি।
করোনায় যখন চলছে কঠোর লকডাউন ঠিক তখন মহাদেবপুর থানা এলাকায় দিনরাত চলছে মাদকের রমরমা ব্যবসা। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, মদ ও গাঁজার মতো মাদক। এমনকি ‘হোম ডেলিভারিও’ হচ্ছে মাদকের। অর্থাৎ করোনাকালে সব কিছু থমকে গেলেও রমরমা কারবার চলছে মাদকের।এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে মাদকের শতাধিক স্পট রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ স্পটই বেশি। দুপুরের পর থেকেই ওইসব স্পটে মাদকসেবীদের মোটরসাইকল মিছিল শুরু হয়। বুলবুল সিনেমা হল ও খাদ্য গুদাম এলাকার চায়ের দোকান মাদকসেবীদের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়। দুধ-চিনির কড়া চা জোগান দিতে হিমশিম খেতে হয় দোকানিদের। এ জমজমাট আসর চলে মধ্য রাত পর্যন্ত।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, বুলবুল সিনেমা হল, বছনা ব্রিজ, শিবগঞ্জ মোড় নিয়ন্ত্রণ করে খোকন, শাকিল ও সুইট সিন্ডকেট। তারা ফেনসিডিল, ইয়াবা এবং গাঁজা বিক্রি করে। চাহিদা পেলে হোম ডেলিভারি দেয় তারা। জানতে চাইলে দাবি করেন, তারা মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত নয়। চকগোবিন্দ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে এলাকার বহুল পরিচিত ফেনসিডিল ব্যবসায়ী বদি। বদির নামে ফেনসিডিল বিক্রির অসংখ্য মামলা রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে থানা পুলিশ। বদি অবশ্য মাদক বিক্রির অভিযোগ অস্বীকার করেন। লিছু বাগান এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে মামি-ভাবি সিন্ডিকেট। প্রতিদিন তারা শত শত ইয়াবা এবং ১০০-২০০ গ্রাম হেরোইন বিক্রি করে। ফায়ার সার্ভিস এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিদিন কেজি কেজি গাঁজা বিক্রি করে রিক্ত সিন্ডকেট।
সচেতন এলাকাবাসীর অভিযোগ, মাদক ব্যবসায়ীরা এখন অনেকেই পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত। মাদক উদ্ধার ও ব্যবসায়ী গ্রেপ্তারে পুলিশের বিশেষ কোনো তৎপরতা নেই। মাঝেমধ্যে চুনোপুঁটিদের আটক করলেও গডফাদাররা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। র্যাব-৫ মাদকের বড় বড় চালানসহ ব্যবসায়ীদের আটক করলেও রহস্যজনক কারণে পুলিশ বড় ব্যবসায়ীদের খুঁজে পায়না।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একাধিক খুচরা মাদক ব্যবসায়ী বলেন, পুলিশকে ম্যানেজ না করে মাদক ব্যবসায় টিকে থাকা অসম্ভব। কলেজ শিক্ষার্থী ওমর ফারুক, রুহুল ও লোকমান বলেন, মহাদেবপুর এখন হয়ে উঠেছে মাদক ব্যবসায়ীদের অভয়ারণ্য। উপজেলা সদরের বাসিন্দা স্কুল শিক্ষক ফয়জুল ইসলাম বলেন, মাদকের নীল ছোবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম, যা ভবিষ্যতের জন্য চরম উদ্বেগজনক।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মহাদেবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এর দায়িত্বে থাকা ইন্সপেক্টর তদন্ত আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাদকের সঙ্গে কোনো আপস নেই। মাদক নিয়ন্ত্রণে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। ব্যবসায়ীদের আটক করে মামালাও করছেন তারা।#
সোহেল রানা, মহাদেবপুর-নওগাঁ, ২৯.০৭.২১, ০১৭১২৩৩৭২৮৩



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন